জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের করুন জীবন চিত্র পর্ব -০১
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রা খুবই কষ্টের। এক একজনের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে এক একটি বেদনাদায়ক মর্মাহত গল্প। শুনলে গায়ের লোম শিউরে ওঠে। দোষ দিতে হয় সৃষ্টিকর্তাকে , তবুও সবকিছু মেনে নিয়ে জীবন সংগ্রামে পাড়ি দিচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের গরিব অসহায়ের কিছু মানুষ। সাহায্য ও সহযোগিতার হাতে বাড়িয়ে দিলে তারা হয়তো স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারত। তেমনি এক করুণ চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই গল্পটি।
জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের করুন জীবন চিত্র পর্ব -০১
বাংলদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে বসবাসরত অসহায় নারী বুলি দাসী। তার স্বামীর নাম মৃত অরুন মন্ডল। দারিদ্র এক গরীব পরিবারে তার জন্ম। অনেক ভাই-বোন থাকায় অভাবের তাড়নায় তিনি লেখাপড়া করতে পারেননি । সংসার বড় হওয়ায় তাদের দিন চলত খাটা খাটনির মধ্য দিয়ে। এমনকি তিনিও লোকের বাসায় কাজ করতেন। সাত বছর বয়স থেকে তিনি কাজ করতেন। বয়স তখন শুধু ছিল সংখ্যা মাত্র। যখন তার বয়স ১০ বছর তখন তাকে বিয়ে দেন এক গরীব পরিবারের ছেলের সাথে। সেখানে গিয়েও তার সুখের সন্ধান মিলল না । তার জীবনে নেমে আসে আরো এক দুঃখের কালো ছায়া।
আরও পড়ুনঃ ওজন অনুযায়ী কতটুকু পানি পান করা উচিত
সেখানে শুধু অশান্তি আর অশান্তি। তার শশুর ছিল না ছিল একমাত্র শাশুড়ি আর স্বামী। তেমন কোন আয় করত না, শাশুড়ি এটা নিয়ে শুধু ঝগড়া করতো এবং তার উপর অনেক নির্যাতন করতো। তাদের মত করে চাল চেপে দিত রান্না করতে , তারা খাওয়ার পর যা থাকতো তাই খেতো, না থাকলে না খেয়ে থাকতে হতো। ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় লোকের কাছ থেকে ও তিনি ভাত চেয়ে খেয়েছে। এমনকি শাশুড়ি সব সময় বলতো গরিব ছেলে দেখে বিয়ে করেছো তো বাবার বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসবা না । ব্যবসার জন্য টাকা নিয়ে এসো , আমার ছেলে ব্যবসা ছাড়া কিছু করতে পারবে না। অথচ তার বাবার দেওয়ার মতো কোন কিছুর সামর্থ্য নেই। তারপরও তাকে অনেক নির্যাতন করতে থাকে।
এভাবে এক পর্যায়ে তার শাশুড়ির সাথে একদিন ঝগড়া করে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তার স্বামীকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি চলে আসে। তার বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সব জায়গা ছিল খাস জমি । কিন্তু বাবার বাড়িতে এসে একটু নিঃশ্বাস ছাড়ছিলেন তিনি। এভাবে কয়েক দিনের মধ্যে তার একটা ছেলে সন্তান হয় । এভাবে ১৮ মাস পরপর তার গর্ভে তিনটি সন্তান হয়। একটা ছেলে ও দুইটা মেয়ে। তার অনেক কষ্ট হয়ে পড়ে এই ছোট ছোট তিনটি বাচ্চা পালতে। এই বাচ্চা পালার কষ্টের মধ্য দিয়ে তিনি তার স্বামীকে হারান। তার স্বামী সুন্দর বনে মাছ ধরে তাদের সংসার চালাত। তার জীবনের নেমে এলো আরেকটি দুঃখের কালো ছায়া। কিভাবে এই তিনটি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে মানুষ করবে, কিভাবে তাদের মুখে খাবার যোগাবে। এই ভেবে ভেবে তার দিন পেরিয়ে রাত যেতে লাগলো।
একদিন তিনি মনস্তাপ করলেন তাকে আর বসে খেলে চলবে না। তাকে কিছু একটা করতে হবে। এই ভেবে যে নেমে গেলেন জীবন সংগ্রামের যুদ্ধে। আরেকজনের সাথে তিনি যোগাযোগ করে তাদের সাথে তার স্বামীর মত নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া শুরু করেন। এভাবে কোনরকমে তাদের জীবন কাটতে থাকে। সে তার ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করায় লেখাপড়া করার জন্য, নদীতে পোনা ধরে সেই পোনা বিক্রি করে তার সংসার চালাত এবং ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খরচ বহন করত। তিনি সমিতি থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে একটা ঘর ও তৈরি করেন, ভালো হবে বসবাস করার জন্য। ঘরবাধার এক বছর পর ২০০৯ সালে আইলায় তার ঘর ভেঙে যায়। ফলে তাঁর জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে । তার বসবাসের ঘরটা লোনা পানিতে ডুবে যায়। দিনের বেলা এভাবে সেভাবে কাটলেও রাতে তাদের ঘুমানোর মতো কোনো পরিবেশ নাই। এভাবে কয়েকদিন জোয়ার- ভাটা হয়। জোয়ার -ভাটা একটু কমলে কয়েকজনের ডেকে ঘরটা আবার উঠিয়ে নিল বসবাস করার মত।
আরও পড়ুনঃ মিষ্টি কুমড়ার বীজ খেলে কোন ধরণের রোগ ভালো হয়
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের বারবার আঘাত হানে যেমন বাধ ভাঙ্গা, উচ্চ জোয়ার- ভাটা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবারো উপকূলীয় অঞ্চলে নেমে আসলো ভয়াবহ সিডর। এই সিডরেও আবার ও ভাঙাচোরা, জোড়া তালি দেওয়া ঘরের চালটা উড়ে নিয়ে যায়। এই ঘর ভাঙ্গাতে সে আবারও অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে স্থায়ী ও কিছু বিত্তবান লোকেরা তাকে সহযোগিতা করে তার ঘরটা আবার মেরামত করে দেয়। এটার দিক থেকে সে সহযোগিতা পেলেও রক্ষা পেল না তার শারীরিক দিক থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বারবার লোনা পানি পুকুরে প্রবেশ করায় পুকুরের পানি অতিরিক্ত লোনা হয়ে যায়। ফলে শারীরিক দিক দিয়ে ও তিনি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুরু হয় তার যোনিপথের চুলকানি। তারপর আস্তে আস্তে জরায়ুর সমস্যা দেখা দিতে লাগলো।
দারিদ্রতার অভাবে সে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেনা। পরবর্তীতে সে রোগের জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সুদে টাকা ধার নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ডাক্তার তাকে রিপোর্ট দেয় যে তার জরায়ুতে ছোট্ট একটা টিউমার হয়েছে। সেখান থেকে ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলে ও সব ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই। তবুও কিছু ওষুধ কিনে খেয়ে একটু কমছে তারপরও একবারে নির্মূল হয়নি। এখনো প্রতিদিন জরায়ুর জন্য ওষুধ খেতে হয়। এভাবে যেতে যেতে অর্থের অভাবে লেখাপড়ার খরচ জগতে না পারায় তার বড় মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিয়ে দেয় এক পাগল ছেলের সাথে। সেখানে সে সংসার করতে না পেরে ,আবার ফিরে আসতে হয় পূর্বের জায়গায় তার মায়ের কাছে। সেখানে তার সংসার করা হলো না। বলিদাসের জীবনে নেমে এলো আরেকটি শোকের ছায়া।
আরও পড়ুনঃযে ১২টি রোগের উপশম হবে খালি পেটে এক কোয়া কাঁচা রসুনে
একের পর এক দুঃখের কালো ছায়া যেন তার জীবন সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয় দুঃখ তার জীবনের এপিট ওপিট। সে টেনশানে আরো বিমোহিত হয়ে পড়ে। তার মেয়েটি ছিল অনেক সুন্দর । সেজন্য তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে গ্রামের অনেক বকাটে ছেলে তাকে উত্তপ্ত করত , ডিস্টার্ব করত , এমনকি তাকে ইভটিজিং করার মত হুমকি দিত। তারা মান সম্মানের ভয়ে কাউকে জানতো না ।এভাবে কয়েকদিন পরে তার সেই মেয়েকে ধর্ষণ করে, মেরে ওড়না দিয়ে ঘরের আড়াই তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। বলিদাসের জীবনে দুঃখ আর দুঃখ । সুখের দেখা মিলছে না তার জীবনে। মনে হয় সৃষ্টিকর্তা তার জীবনে সুখের অধ্যায়টা লিখতে ভুলে গিয়েছিল।
অর্থের অভাবে মামলা করতে পারল না। পরবর্তীতে সাংবাদিকদের কথা শুনে কিছু টাকা সুদে ধার নিয়ে মামলা করছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকার অভাবে মামলা শেষ করতে পারেননি। কিছুদিন পর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবারও উপকূলে অঞ্চলে নেমে আসলো আমফাম ঝড়। সেই ঝড়ে তার ঘরের তেমন কোন ক্ষতি না হলেও পড়ে গিয়ে তার একটা পা ভেঙে গিয়েছিল। সেখান থেকে তিনি আর কোন প্রকার ভারী কাজ করতে পারেন না। তার ছেলে একা ইট ভাটায় কাজ করে অনেক কষ্টে সংসার চালায়। তার পক্ষে সংসার চালানো ও অন্যান্য খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এমত অবস্থায় সে যদি সরকার বা কিংবা কোন বিত্তবানদের সহযোগিতা পেতো তাহলে হয়তোবা সুখের দেখা না মিললেও স্বাভাবিক মানুষের মত জীবন যাপন করতে পারত। এভাবে লুকিয়ে থাকে সমাজের আশেপাশে কত হাজারো বুলিদাসীর মত জীবনের গল্প। ধন্যবাদ সবাইকে এতক্ষন আমাদের সাথে থাকার জন্য। সুস্থ থাকবেন। ভালো থাকবেন । নিরাপদে থাকবেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url